শ্যাসীকে বললাম, ‘লাভ ইন ওকিনাওয়া’ মুভিটা দেখেছ? না। আসলে আমিও দেখিনি। কিন্তু ওকিনাওয়ার প্রতি এক অসাধারন প্রেম আছে আমার। পৃথিবীর সেরা সুখী আর দীর্ঘজীবী মানুষেরা নাকি এখানে থাকে। কিন্তু কেন:
১. জীবনের মানে নাকি কি তারা আবিস্কার করে ছোট ছোট কাজে। ‘IKIGAI’ জাপানিজ এই দর্শন হচ্ছে ছোট ছোট কাজে নিরন্তন ছুটে চলা। আইনস্টাইন পদার্থ বিজ্ঞানী না হলে, হতেন গায়ক, এবং মৃত্যুর আগমুহুর্তেও পিয়ানো বাজিয়ে গেছেন। ছোট পিয়ানোতেই হয়তো বড় সুখ পেতেন। বিল গেটস রাতে প্লেট ধোয়াতেই এখনো সুখ পান। জাপানিজ নাগরিকেরা ”KAIZEN’ উপায়ে ছোট ছোট কাজে নিরন্তন ছুটে চলাতেই সুখ, শান্তি, সিদ্ধি ও সুদীর্ঘ জীবন পায়। ‘IKIGAI: The Secret to a Long and Happy Life’ বইয়ে এরকম ছোট ছোট অনেক ভালবাসার কথায় ভরপুর জীবনের কথা বলা আছে।
২. কখনো কি গাছ, মাছ, পাখি ও পতঙ্গ এর সাথে কথা বলেছি, কান পেতে কি শুনেছি। নৈশব্দে ঝি ঝি পোকার গান, অন্ধকারে জোনাকির আয়োজন, মাছরাঙা বা বকের ধ্যান, বটের শিকড়, বৈদিক আগুন, পারিজাত কুসুম, রাঙাবালিয়ার সন্দিগ্ধপুকুর, মৌপিপাসার নদ, নীল কৈবর্ত্য, ভাঁটফুল বা জলাজ্ঞীর খাল। Neil Pasricha এর বই The Book of Awesome এ ক্ষণে অনুক্ষনে পরতে পরতে 1000awesome things এর উদাহরণ দিয়েছেন। নগরায়িত বুর্জ দুবাইয়ের কৃত্রিম ফায়ারপ্লেসের চেয়েও গ্রামবাংলার অকৃত্রিম খড়ের আগুনের আলোয় যে জীবন, তা অধিকতর আলোকময় হতে পারে।
৩. হুগো, বস, ক্যালভিন কেইনের ৫০ আইটেমের পোষাক না থাকলেও, জামাহীন ছোট বেলার গনিমিয়া শুধু সুখী মানুষই নন, ধরিত্রী রক্ষার এক নির্ভীক সৈনিকও বটে। ছোট ছোট জীবনাচরন শুধু আপনাকেই সুখের সাগরে ভাসাবেনা, বাচাবে ধরত্রীকেও। 6R (Recycle, Reduce, Repair, Refill, Retrofit, Recalibrate) জীবন, প্রকৃতি ও পৃথিবীর জন্য খুবই দরকার। দামী ব্রান্ডের অধিক জিনিস দিয়ে সময় নিয়ে সাজবেন,নাকি সূর্যের হাসিতে আপনিও হাসবেন, সেটি আপনার বিষয়, কিন্ত মৃন্ময়ী মৃত্তিকার ক্ষতি করবেন না। গার্মেন্টস ও জুতার কারখানা থেকে পৃথিবীর ৮% গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গত হচ্ছে। প্রয়োজনের অধিক যাই কিনেন না, এই পৃথিবী আমাদের কাজ থেকে এর পাই পাই হিসেব নিবে। গড়ে একজন মানুষ ২৫ পাউন্ড কাপড় ব্যবহার করে, যার জন্য প্রায় ১৫০০ কিমি গাড়ী ব্যবহার করার মতো গ্যাস নির্গত করে। টেকসই পৃথিবীর জন্য মিনিমালিস্ট গনিমিয়া হবেন নাকি হুট করে এসে লুট করে চেটেপুটে সব খেয়ে যাবেন, সিদ্ধান্ত একান্তই আপনার।
৪. অন্ধকার থেকে আলোর যাত্রাই জীবন যাত্রা। জীবনের নিবির নিলয়ের জন্য পুলিশ, প্রশাসক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে, তা নয়। কালের এই ক্ষণিকালয়ে ফটোগ্রাফি, মাউন্টেনিয়ারিং, স্কেটিং, বার্ডিং, সাইক্লিং, সুইমিং, প্লাম্বিং, হাইকিং, ক্লিনিং,ভ্লগিং, ব্লগিং সহ নানাবিধ ছোট ছোট কাজ করেও শান্তি পাওয়া যেতে পারে।
৫. তাহলে জীবিকার কি হবে? দুমুঠো অন্য জুটবে কিভাবে? দুটো মোটা কাপড়ের সংস্থান হবে কি? অবশ্যই হবে। মহান স্রস্টা হিউমান প্লানেটের সবার জন্যই আয়োজন রেখেছেন, কিন্তু শয়তান সর্বদাই আমাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, কি হবে কি না হবে এসব ভয় দেখায়। গান্ধীজীর কথাটি হয়তো গনিমিয়া তার জীবনাচরনে ধাতস্থ করেছেন ” The World has enough for everyone’s needs, but not পeveryone’s greed.”
৬. এই লেখাটি অস্থির সময়ের অশান্ত মনের অতিরিক্ত কর্মমুখর পৃথিবীর বিপরীতে একটি কাউন্টার ন্যারেটিভ। কর্মহীনতা নয়, বরং ছোট ছোট সকল কাজেই ভালবাসা খুঁজে পাওয়া। ছোট ছোট ভালাবাসাই গড়ে উঠে প্রশান্ত আত্মার সুদীর্ঘ মহৎ জীবন।
আমার বন্ধু শ্যাসীকে নিয়ে নিভৃত কোন এক পাড়াগাঁয়ে নদীর পারে জোস্নাস্নাত রাতে বসে শব্দহীন কথামালার ফুলঝুরিতে অজস্র নির্ঘুমরাত কাটিয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখি।
শ্যাসীকে এই স্বপ্নের কথা বলতেই, বললো, চল পালাই, আবার অরণ্যে, কোন এক দারুচিনি দ্বীপে।